গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হলো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। এই নির্বাচন পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি হলেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৫ সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের একটি শক্তিশালী প্যানেল প্রস্তুত করার নির্দেশিকা জারি করেছে। এই নিবন্ধে আমরা নির্বাচন কমিশনের সেই নির্দেশনা, প্যানেলে অন্তর্ভুক্তির শর্তাবলী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্যানেল প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তা:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগের জন্য একটি সুসংগঠিত প্যানেল তৈরি করা অপরিহার্য। এই প্যানেল তৈরির মাধ্যমে যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব হবে, যা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করে এই প্যানেল প্রস্তুত করা হবে।
২. প্যানেলে অন্তর্ভুক্তির শর্তাবলী:
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত নিম্নলিখিত শর্তাবলী সাপেক্ষে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে:
২.১ প্রিজাইডিং অফিসার:
প্রিজাইডিং অফিসার প্যানেলে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিম্নলিখিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিবেচিত হবেন:
- সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত অফিসের প্রথম শ্রেণির/প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাবৃন্দ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কলেজ/সমমানের মাদ্রাসার শিক্ষক, ক্ষেত্রবিশেষে ডেমনস্ট্রেটর/কর্মকর্তাবৃন্দ।
- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তাবৃন্দ।
- প্রয়োজনবোধে বেসরকারি ব্যাংক, বীমা অথবা নির্ভরযোগ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ কর্মকর্তা/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/কলেজ শিক্ষক/প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক/শিক্ষকবর্গ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়/মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমমানের মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক, ক্ষেত্রবিশেষে সিনিয়র শিক্ষকবর্গ।
২.২ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার:
সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার প্যানেলে নিম্নলিখিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিবেচিত হবেন:
- সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত অফিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা/দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তাবৃন্দ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কলেজ/সমমানের মাদ্রাসার ডেমনস্ট্রেটর/কর্মকর্তাবৃন্দ।
- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেশন অথবা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় শ্রেণির/দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তাবৃন্দ।
- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়/রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকবর্গ।
- প্রয়োজনবোধে বেসরকারি ব্যাংক, বীমা অথবা নির্ভরযোগ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/কোন প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় শ্রেণির/দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তাবৃন্দ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়/মাধ্যমিক বিদ্যালয়/সমমানের মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষক/সিনিয়র শিক্ষক/শিক্ষকবর্গ।
২.৩ পোলিং অফিসার:
পোলিং অফিসার প্যানেলে নিম্নলিখিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিবেচিত হবেন:
- সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত অফিসের কর্মচারীবৃন্দ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কলেজ/সমমানের মাদ্রাসার কর্মচারীবৃন্দ।
- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা, কর্পোরেশন অথবা অনুরূপ কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীবৃন্দ।
- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়/রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবর্গ।
- প্রয়োজনবোধে বেসরকারি ব্যাংক, বীমা অথবা নির্ভরযোগ্য যে কোন বেসরকারি অফিস/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানের উক্তরূপ শিক্ষক/কর্মচারীবৃন্দ।
- সরকারি/সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়/মাধ্যমিক বিদ্যালয়/সমমানের মাদ্রাসার শিক্ষক/কর্মচারীবৃন্দ।
৩. প্যানেল প্রস্তুতের প্রাথমিক কার্যক্রম:
সিনিয়র জেলা/জেলা নির্বাচন অফিসারগণ তাদের আওতাধীন এলাকায় স্থাপিত সকল সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার প্রধানদের নিকট থেকে শ্রেণি বা গ্রেডভিত্তিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তালিকা চেয়ে অনুরোধ করবেন। এটি প্যানেল প্রস্তুতের প্রথম ধাপ।
৪. প্যানেলে কতিপয় ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করার নির্দেশনা:
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর ৯(১) (১খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে সকল কর্মকর্তা/কর্মচারী/শিক্ষক/শিক্ষিকা সম্পর্কে সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তাঁদেরকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগের জন্য প্যানেলভুক্ত করা যাবে না। এছাড়াও, কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যকে কোনো অবস্থাতেই প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
৫. প্যানেলে বিভিন্ন তথ্য অন্তর্ভুক্তকরণ:
প্যানেল প্রস্তুতের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা, সততা, সাহস এবং নিরপেক্ষতার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের পদমর্যাদা, জ্যেষ্ঠতা, বেতনস্কেল ও মূল বেতন বিবেচনা করা হবে। ব্যক্তিগত বিষয়াদি যেমন- বয়স, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বা অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে তালিকায় চিহ্নিত করতে হবে। উল্লেখ্য, চতুর্থ শ্রেণির (জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড ১৭-২০) কোনো কর্মচারীকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। তবে প্রিজাইডিং অফিসারের সহায়ক বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দায়িত্ব পালনের জন্য চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পৃথক প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে।
৬. মহিলা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্তি:
মহিলা ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটগ্রহণের উদ্দেশ্যে যথাসম্ভব পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা লিঙ্গ সমতা এবং মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে।
৭. ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল চূড়ান্তকরণ:
সিনিয়র জেলা/জেলা নির্বাচন অফিসার কর্তৃক বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারীর তালিকা যাচাই-বাছাই করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল চূড়ান্ত করা হবে। ক্রমিক ২ এ উল্লিখিত শর্তাবলী অনুসরণপূর্বক নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ অতিরিক্ত সংখ্যক প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে।
৮. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে দায়িত্ব পালনকারীদের তালিকা:
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের প্যানেল ছাড়াও, রিটার্নিং অফিসার/সহকারী রিটার্নিং অফিসার, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, নির্বাচনি তথ্য/ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র, ভোটকেন্দ্র বা ভোটগ্রহণের পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রতিবেদন সংগ্রহ ও অন্যান্য কার্য সম্পাদনের জন্য একটি পৃথক প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে।
বিস্তারিত জানতে নির্বাচন কমিশনের অফিস অর্ডারটি দেখতে পারেন: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্যানেল প্রস্তুতকরণ.pdf
উপসংহার:
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৫ সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত এই নির্দেশনা একটি সুশৃঙ্খল ও কার্যকর নির্বাচন পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ এর মধ্যে এই প্যানেল প্রস্তুত করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে অবহিত করার জন্য সকল সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।
আমি একজন অডিটর। সরকারি চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন বিধি বিধান নিয়ে সব সময় স্টাডি করে থাকি। সরকারি সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র প্রায়শই পড়া হয়। তাই নিজের প্রাকটিক্যাল জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করি।