বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ক্ষমতা বলে ‘সরকারি কর্মচারী লিয়েন বিধিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। এই বিধিমালায় সরকারি কর্মচারীদের জন্য লিয়েন সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক, যেমন – লিয়েন অর্জন, সংরক্ষণ, এবং বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরিতে যোগদানের প্রক্রিয়া ও শর্তাবলী বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
লিয়েন কী এবং কীভাবে এটি অর্জিত হয়?
লিয়েন বলতে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ২(১২)-তে সংজ্ঞায়িত একটি বিশেষ অধিকারকে বোঝায় । যখন একজন সরকারি কর্মচারী কোনো স্থায়ী পদে নিয়মিতভাবে নিযুক্ত হন, তখন সেই পদে তার লিয়েন অর্জিত হয় । এর ফলে, পূর্বে অন্য কোনো পদে অর্জিত তার লিয়েন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায় । লিয়েন একজন স্থায়ী পদে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত সরকারি কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য । এটি স্থায়ী পদে কর্মরত থাকা অবস্থায়, বৈদেশিক সার্ভিসে, অস্থায়ী বা অফিসিয়েটিং পদে, যোগদানকালে, ছুটিতে থাকা অবস্থায়, এমনকি সাময়িক বরখাস্ত হলেও সংরক্ষণ করা হয় । তবে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের শিক্ষানবিশকালে লিয়েন অর্জিত হয় না, এটি কেবল স্থায়ী হওয়ার পরই অর্জিত হয় ।
বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন প্রক্রিয়া
সরকারি কর্মচারীরা সরাসরি যেকোনো বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরির জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারেন । তবে, আবেদনের একটি অনুলিপি অবিলম্বে নিজ নিজ চাকরি নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগে পাঠাতে হবে । কিছু ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হয়, যেমন- বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো বৈদেশিক কূটনৈতিক মিশনে চাকরির জন্য আবেদন করলে ।
এছাড়াও, কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদনের জন্য সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই, যেমন:
- বিদেশে কোনো প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান
- দেশ বা বিদেশে অবস্থিত জাতিসংঘ ও এর বহুজাতিক সংস্থাগুলো
- বিদেশি বা বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থা (এন.জি.ও.)
- সরকারের অংশীদার বা মালিকানাধীন লিমিটেড কোম্পানি
এসব ক্ষেত্রে কেবল চাকরি নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে আবেদন সম্পর্কে অবহিত করলেই যথেষ্ট । যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বা সংস্থার মাধ্যমে আবেদনপত্র পাঠানোর নির্দেশনা থাকে, তাহলে প্রার্থীকে তার নিজ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে ।
লিয়েন সংরক্ষণের শর্তাবলী
একজন সরকারি কর্মচারী তার সমগ্র চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত লিয়েন সংরক্ষণ করতে পারেন, যা বিচ্ছিন্নভাবে বা ধারাবাহিকভাবে হতে পারে । এই লিয়েনকাল কেবল চাকরির জ্যেষ্ঠতা, বেতন বৃদ্ধি এবং অবসর গ্রহণের (পেনশন) জন্য গণনাযোগ্য । এই সময়ের জন্য কর্মচারী কোনো বেতন, ভাতা বা ছুটি পাবেন না । যদি লিয়েনকাল একটানা পাঁচ বছরের বেশি হয়, তবে বিশেষ কোনো সিদ্ধান্ত না থাকলে বি.এস.আর. প্রথম খণ্ডের বিধি ৩৪ অনুযায়ী তার সরকারি চাকরির অবসান ঘটবে এবং তার সাথে সরকারের সকল সম্পর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছিন্ন হয়ে যাবে ।
লিয়েন অনুমোদনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পালন করতে হয়:
- চাকরিকাল: লিয়েন সংরক্ষণের জন্য কর্মচারীকে চাকরিতে স্থায়ী হতে হবে এবং তার চাকরিকাল কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে ।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: লিয়েন মঞ্জুরের আগে, কর্মচারীকে সরকারি গাড়ি, টেলিফোন, কম্পিউটার, বই-পত্র এবং অন্যান্য সরকারি সরঞ্জামাদি জমা দিতে হবে এবং সরকারের অন্য কোনো পাওনা থাকলে তা পরিশোধ করতে হবে ।
- আবেদন প্রক্রিয়া: লিয়েন মঞ্জুর হওয়ার আগে কোনো কর্মচারী চাকরিতে অনুপস্থিত থাকতে বা কোনো বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারবেন না । লিয়েনের আবেদন মঞ্জুর হলে, আদেশ জারির আগে কর্মচারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও.এস.ডি.) হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হবে ।
- অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা: লিয়েনকালে কর্মচারীকে যৌথবীমা তহবিল, কল্যাণ তহবিল, ভবিষ্য তহবিল, পেনশন ও লিভ-স্যালারি কন্ট্রিবিউশন এবং অন্যান্য চাঁদা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে ।
- আবাসন: যদি কোনো কর্মচারী সরকারি বাড়িতে থাকেন, তাহলে তাকে বৈদেশিক চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে বাড়ি খালি করে ছয় মাসের ভাড়া পরিশোধ করতে হবে ।
লিয়েন থেকে প্রত্যাবর্তন
লিয়েন শেষে সরকারি কর্মচারীকে অনুমোদিত সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহের মধ্যে সরকারি চাকরিতে পুনরায় যোগদান করতে হবে । যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগদান না করেন, তবে এটি অননুমোদিত অনুপস্থিতি হিসেবে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে । কোনো কর্মচারী যদি অনুমোদিত সময়ের আগেই ফিরে আসতে চান, তাহলে তিনি লিয়েনের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিলের আবেদনসহ যোগদানপত্র দাখিল করতে পারেন ।
বি.এস.আর-এর বিধানাবলী
বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস (বি.এস.আর.) পার্ট-১ অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মচারীর লিয়েন থাকা পদে অন্য কাউকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা যায় না । একইভাবে, যে পদের বেতন লিয়েন থাকা পদের বেতনের চেয়ে কম, সেখানে কাউকে স্থায়ী বা অফিসিয়েটিং পদে বদলি করা যাবে না । কর্মচারীর লিখিত অনুরোধ ছাড়া তার স্থগিতকৃত লিয়েন বাতিল করা যাবে না ।
বিস্তারিত জানতে পিডিএফ ফাইলটি দেখুন: লিয়েন বিধিমালা ২০২১
আমি একজন অডিটর। সরকারি চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন বিধি বিধান নিয়ে সব সময় স্টাডি করে থাকি। সরকারি সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র প্রায়শই পড়া হয়। তাই নিজের প্রাকটিক্যাল জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করি।