বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন নতুন বেতন কাঠামোর জন্য। অবশেষে ২০২৫ সালে ৯ম জাতীয় বেতন স্কেল নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এই আর্টিকেলে আপনি পাবেন সর্বশেষ তথ্য এবং সঠিক খবর।
৯ম পে কমিশন গঠন এবং নেতৃত্ব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ২৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে ৯ম জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে। এই কমিশনে মোট ২২ জন সদস্য রয়েছে।
কমিশনের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি:
- সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান
- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
- সরকারি মঞ্জুরিপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়
- রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা
পে কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১ৄ আগস্ট ২০২৫। কমিশনকে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী, কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ফেব্রুয়ারি ২০২৬।
অর্থ উপদেষ্টার নির্দেশনা
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ পে কমিশনকে প্রতিবেদন তৈরি করার সময় বিশেষভাবে দুটি বিষয় বিবেচনা করতে বলেছেন:
- দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
- মূল্যস্ফীতির বিষয়
তিনি বলেছেন, “আমাদের পরিকল্পনা হলো সময়োপযোগী একটি বেতন কাঠামো ঘোষণা করা।”
বর্তমান বেতন কাঠামোর সমস্যা
২০১৫ সালের পে স্কেল অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু:
- গত ৮ বছরে ৪০% বেতন বৃদ্ধি হলেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫০-২০০%
- চলতি বছরে দ্রব্যমূল্য ৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে
- সরকারি কর্মচারীরা বার্ষিক প্রায় ৫% হারে ইনক্রিমেন্ট পান
- বর্তমানে ২০টি বেতন গ্রেড রয়েছে
বর্তমান বেতন পরিসীমা:
- প্রথম গ্রেডের বেতন: ৭৮,০০০ টাকা
- ২০তম গ্রেডের বেতন: ৮,২৫০ টাকা
প্রস্তাবিত ৯ম পে স্কেলের বৈশিষ্ট্য
গ্রেড সংখ্যা পরিবর্তন
সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো ২০টি গ্রেড থেকে কমিয়ে ১২টি গ্রেড করার দাবি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি:
- গ্রেড যত কম হবে, বৈষম্য তত কম হবে
- ১২ গ্রেড হলে নিচের কর্মচারীরা বেশি লাভবান হবে
- প্রতি গ্রেডে বেতন ব্যবধান কমে যাবে
প্রস্তাবিত বেতন পরিসীমা
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী ৯ম পে স্কেলে:
- সর্বনিম্ন বেতন: ৩৫,০০০ টাকা
- সর্বোচ্চ বেতন: ১,৪০,০০০ টাকা
- ১:৪ অনুপাতে বেতন নির্ধারণ
১২ গ্রেডের প্রস্তাবিত কাঠামো:
- ১ম গ্রেড: ১,২৫,০০০ – ১,৪০,০০০ টাকা
- ২য় গ্রেড: ১,১৫,০০০ – ১,৩০,০০০ টাকা
- ৩য় গ্রেড: ১,০৫,০০০ – ১,২০,০০০ টাকা
- ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে
- ১২তম গ্রেড: ৩৫,০০০ – ৪০,০০০ টাকা
কর্মচারীদের অন্যান্য দাবি
৯ম পে স্কেলের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলোর আরও দাবি রয়েছে:
বেতন সংক্রান্ত:
- বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১০% নির্ধারণ
- টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল
ভাতা সংক্রান্ত:
- ঢাকা মহানগরে বাড়ি ভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৮০%
- বিভাগীয় শহরে ৭০%
- জেলা শহরে ৬৫%
- উপজেলা/থানা শহরে ৬০%
পেনশন সংক্রান্ত:
- ১০০ ভাগ পেনশন পুনর্বহাল
- পেনশন গ্র্যাচুইটির হার ১:৫০০ টাকা নির্ধারণ
মহার্ঘ ভাতার ব্যবস্থা
নতুন পে স্কেল ঘোষণা ও বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিজীবীরা মহার্ঘ ভাতা পাবেন।
বিশেষত ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
নির্বাচন এবং বাস্তবায়নের সময়সূচি
অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে:
সরকারের পরিকল্পনা:
- আর্থিক সংকট বিবেচনায় নির্বাচনের আগে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার সম্ভাবনা কম
- পে-কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়লে সরকার একটি সুপারিশমালা চূড়ান্ত করে রাখবে
- নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে তা বাস্তবায়ন করবে
কর্মচারীদের প্রত্যাশা:
সরকারি কর্মচারী সংগঠনের দাবি ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে ৯ম পে স্কেলের প্রজ্ঞাপন এবং জানুয়ারি ২০২৬ থেকে কার্যকর করা।
পে স্কেল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া
সাধারণত পে কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হতে কয়েক মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। তবে কমিশন সাধারণত সুপারিশ করে যে নতুন পে স্কেল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন থেকেই কার্যকর করা হোক।
বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ
পে কমিশনের কাজ চলমান রয়েছে। কমিশনের সভাপতি জাকির আহমেদ খান জানিয়েছেন যে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিবেদন তৈরি করার চেষ্টা করবেন।
গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো:
- ২৪ জুলাই ২০২৫: পে কমিশন গঠন
- ১৪ আগস্ট ২০২৫: প্রথম বৈঠক
- ফেব্রুয়ারি ২০২৬: প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা
সুবিধা এবং প্রভাব
৯ম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়িত হলে:
- বৈষম্য হ্রাস: গ্রেড কমে গেলে বেতনের ব্যবধান কমবে
- ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি: মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধি
- কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি: যুক্তিসঙ্গত বেতন কর্মচারীদের মনোবল বাড়াবে
- জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: বর্ধিত বেতনে সংসার চালানো সহজ হবে
উপসংহার
৯ম জাতীয় বেতন স্কেল ২০২৫ বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। যদিও বাস্তবায়নে কিছু সময় লাগবে, তবে কমিশনের কাজ এগিয়ে চলেছে। মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড সংখ্যা হ্রাসের মাধ্যমে বৈষম্য কমানো এবং সার্বিকভাবে কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এই নতুন বেতন কাঠামো একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে।
সরকারি কর্মচারীরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন এই নতুন বেতন কাঠামোর জন্য। তবে এই সময়ে তারা মহার্ঘ ভাতা পাবেন, যা কিছুটা হলেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে।
আমি একজন অডিটর। সরকারি চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন বিধি বিধান নিয়ে সব সময় স্টাডি করে থাকি। সরকারি সরকারি আদেশ, গেজেট, প্রজ্ঞাপন ও পরিপত্র প্রায়শই পড়া হয়। তাই নিজের প্রাকটিক্যাল জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করি।