পিআরএল (PRL) বিধিমালা: অবসরের তারিখ নির্ধারণ ও আবেদন প্রক্রিয়া

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অবসর-উত্তর ছুটি (Post-Retirement Leave) বা পিআরএল একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা। পেনশন বিধিমালা অনুসারে পিআরএলের সাথে লাম গ্র্যান্ট ও গ্র্যাচুইটি (আনুতোষিক) মঞ্জুর করা হয়। এই নির্দেশিকায় পিআরএল নিয়ম, অবসরের তারিখ বের করার পদ্ধতি এবং আবেদন প্রক্রিয়া বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

অবসরের তারিখ কীভাবে বের করবেন?

সরকারি চাকরিতে অবসরের তারিখ নির্ধারণ একটি সহজ গাণিতিক প্রক্রিয়া। আপনার জন্মতারিখের সাথে ৫৯ বছর যোগ করলেই অবসরের তারিখ পাওয়া যায়। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ৬০ বছর যোগ করতে হয়।

অবসরের তারিখ হিসাবের উদাহরণ

যদি কোনো কর্মচারীর জন্মতারিখ ৭ জুলাই ১৯৮০ হয়, তাহলে:

  • সাধারণ কর্মচারী: ১৯৮০ + ৫৯ = ২০৩৯ সাল
  • প্রথম অবসরের তারিখ: ৭ জুলাই ২০৩৯
  • পিআরএল শুরুর তারিখ: ৬ জুলাই ২০৩৯ (১ দিন বিয়োগ)
  • চূড়ান্ত অবসর: ৭ জুলাই ২০৪০ (১ বছর পিআরএল ভোগের পর)

মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে ৬০ বছর যোগ করে একইভাবে হিসাব করতে হবে।

পিআরএল শুরুর তারিখ নির্ণয়ের নিয়ম

পিআরএল বা অবসর-উত্তর ছুটির শুরুর তারিখ বের করতে আপনাকে তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে:

১. জন্মতারিখের সাথে ৫৯ যোগ করুন (মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৬০)

২. প্রাপ্ত তারিখ থেকে ১ দিন বিয়োগ করুন

৩. যে তারিখ পাবেন সেটিই পিআরএল শুরুর তারিখ

এই পিআরএল এক বছর ভোগ করার পর কর্মচারী চূড়ান্তভাবে অবসরে যান। অর্থাৎ পিআরএল শুরুর বছরের সাথে ১ বছর যোগ করলেই চূড়ান্ত অবসরের বছর পাওয়া যায়।

পিআরএল আবেদন কখন দাখিল করবেন?

সময়মতো পিআরএল আবেদন দাখিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিলম্বে আবেদন করলে লাম গ্র্যান্ট ও পেনশন মঞ্জুরিতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

আবেদনের সময়সীমা

  • নিয়মিত পিআরএল: পিআরএল শুরুর কমপক্ষে ৩ মাস পূর্বে আবেদন দাখিল করতে হয়
  • স্বেচ্ছায় অবসর: ১ মাস পূর্বে জানালেই যথেষ্ট
  • বিলম্বের দায়: সঠিক সময়ে আবেদন না করলে সকল দায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপর বর্তাবে

পিআরএল আবেদনের জন্য কোনো নির্ধারিত ফরম্যাট নেই। সাদা কাগজে সঠিক তথ্যসহ আবেদন করলেই হবে।

পিআরএল মঞ্জুরির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

পিআরএল ও লাম গ্র্যান্ট পেতে হলে নিম্নলিখিত কাগজপত্র দুই কপি করে দাখিল করতে হবে:

মূল দলিলপত্র

১. পিআরএল আবেদনপত্র (২ কপি)

২. প্রত্যাশিত শেষ বেতনের প্রত্যয়ন পত্র (ELPC) – হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে

৩. এসএসসি পাশের সনদপত্র (জন্ম তারিখ প্রমাণের জন্য)

৪. সার্ভিস বুক (যাদের আছে)

৫. সকল কর্মস্থলের চাকরির প্রত্যয়ন পত্র (সত্যায়িত কপি, ২ সেট)

৬. সর্বশেষ কর্মস্থলের প্রত্যয়ন পত্র (নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরযুক্ত)

প্রত্যয়ন পত্রসমূহ

আপনার কোনো সরকারি পাওনা বা মামলা নেই তা প্রমাণ করতে হবে:

  • সরকারি পাওনা নেই মর্মে প্রত্যয়ন (টেলিফোন বিল, বিদ্যুৎ বিল, বাড়ি ভাড়া, যানবাহন ভাড়া)
  • অগ্রিম ঋণ পরিশোধের প্রমাণ (যানবাহন ঋণ, আবাসন ঋণ ইত্যাদি)
  • ফৌজদারি মামলা নেই মর্মে প্রত্যয়ন
  • বিভাগীয় মামলা নেই মর্মে প্রত্যয়ন
  • নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নেই মর্মে প্রমাণপত্র
  • দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা নেই মর্মে প্রত্যয়ন
  • অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তি নেই মর্মে প্রমাণপত্র

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা

যদি কোনো অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তি বা বিভাগীয় মামলা চলমান থাকে, তাহলে পেনশনের ২০% আটকে রেখে বাকি অর্থ প্রদান করা হয়। বিভাগীয় মামলার ক্ষেত্রে পিআরএল শুরুর ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য তাগিদ দেওয়া হয়।

ছুটি জমা না থাকলে কী হবে?

পিআরএল ভোগ করতে হলে অবশ্যই ১২ মাস ছুটি জমা থাকতে হবে। ছুটি নগদায়ন বা লাম গ্র্যান্ট পেতে চাইলে মোট ৩০ মাস ছুটি জমা থাকা প্রয়োজন (পিআরএলের জন্য ১২ মাস + ছুটি নগদায়নের জন্য ১৮ মাস)।

ছুটি কম থাকলে

  • ১২ মাসের কম ছুটি থাকলে: পিআরএল দেওয়া হবে না, সরাসরি চূড়ান্ত অবসরে পাঠানো হবে
  • ৬ মাস ছুটি থাকলে: শুধুমাত্র ৬ মাসের লাম গ্র্যান্ট দেওয়া হবে
  • ছুটি না থাকলে: লাম গ্র্যান্ট ও পিআরএল কোনোটিই পাবেন না

চাকরি শেষে সাধারণত ৪-৫ বছরের ছুটি জমা থাকে। তবে যারা নিয়মিত ছুটি ভোগ করেন তাদের ছুটি কম জমা থাকতে পারে।

জিপিএফ তোলা ও পিআরএল

পিআরএল শুরুর পূর্বে জিপিএফ (সাধারণ ভবিষ্য তহবিল) এর টাকা তোলা যায়। যদি পিআরএল না পান তাহলে চূড়ান্ত অবসরের কাগজপত্র দাখিল করে আনুতোষিক, এককালীন টাকা এবং জিপিএফের সম্পূর্ণ অর্থ তুলে নিতে পারবেন।

পিআরএল কালীন ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায় কি?

না, পিআরএল কালীন সময়ে কোনো বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট পাওয়া যায় না। তবে পিআরএল শেষে পেনশন ও আনুতোষিক নির্ধারণের জন্য একটি ইনক্রিমেন্ট যুক্ত করা হয়।

ইনক্রিমেন্টের উদাহরণ

  • জুলাই মাসে পিআরএল শুরু: চাকরিকালীন ইনক্রিমেন্ট পাবেন না, শুধু পেনশন নির্ধারণের ইনক্রিমেন্ট পাবেন
  • আগস্টে পিআরএল শুরু: জুলাইয়ের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট পাবেন + পেনশন নির্ধারণের ইনক্রিমেন্ট পাবেন

মূল পয়েন্টসমূহ: দ্রুত চেকলিস্ট

অবসরের হিসাব: জন্মতারিখ + ৫৯ বছর (মুক্তিযোদ্ধা ৬০ বছর)
পিআরএল শুরু: অবসরের তারিখ থেকে ১ দিন আগে
আবেদনের সময়: পিআরএল শুরুর ৩ মাস পূর্বে
প্রয়োজনীয় ছুটি: পিআরএলের জন্য ১২ মাস, লাম গ্র্যান্টসহ ৩০ মাস
কাগজপত্র: আবেদন, ELPC, জন্ম সনদ, প্রত্যয়নপত্র (২ কপি)
সব পাওনা পরিশোধ: বিল, ঋণ, আবাসন ভাড়া সব নিষ্পত্তি করুন
মামলামুক্ত থাকুন: ফৌজদারি, বিভাগীয়, অডিট আপত্তি সব সমাধান করুন

পরিশেষে

পিআরএল বিধিমালা মেনে চলা এবং সময়মতো সঠিক কাগজপত্র দাখিল করা প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। তিন মাস পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিন, সব প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করুন এবং নির্ধারিত সময়ে আবেদন জমা দিন। এতে আপনার পিআরএল, লাম গ্র্যান্ট ও পেনশন মঞ্জুরিতে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে না। মনে রাখবেন, বিলম্বে আবেদনের সকল দায় আপনার নিজের উপরই বর্তাবে।

দ্রষ্টব্য: এই তথ্যগুলো বাংলাদেশ সরকারের পিআরএল ও পেনশন বিধিমালা অনুযায়ী সংকলিত। যেকোনো আপডেট বা পরিবর্তনের জন্য আপনার হিসাবরক্ষণ অফিস বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করুন।

Leave a Comment